টক দই এর উপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম
টক দই এর উপকারিতা এবং খাওয়ার নিয়ম
দই অনেক প্রাচীন একটি খাবার। আর টক দই এক ধরনের দই । মানবজাতির ইতিহাসে মানুষ প্রায় ৪৫০০ বছর আগে থেকেই দই বানানোর প্রচলন করেছিলো। খেতে সুস্বাদু ও পুষ্টিসমৃদ্ধ এই খাবারটি প্রায় সবার প্রিয়। আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করব, টক দই এর উপকারিতা ও খাওয়ার নিয়ম নিয়ে যা থেকে আপনারা দই এর সম্পর্কে বিস্তারিত জানতে পারবেন।
টক দই
টক দুই এক প্রকার দই যা খেতে টক এবং অম্লীয় স্বাদযুক্ত । টক দই তৈরি হয় গরুর দুধ থেকে। দুধ থেকে গাঁজন করার মাধ্যমে এটি পাওয়া যায় । বাণিজ্যিকভাবে দুধ থেকে তৈরি হয় এটি যাতে একটি অ্যাসিডিফাইং এজেন্ট থাকে । কখনও কখনও নির্দিষ্ট ব্যাকটেরিয়া যোগ করা হয়।। টক দই একটি প্রোবায়োটিক খাবার যা অন্ত্রের উপকারী ব্যাকটেরিয়ার সংখ্যা বৃদ্ধি করে হজমশক্তি ভালো রাখে।
দই এর পুষ্টিগুন
পুষ্টিকর এবং সুস্বাদু খাবার হিসেবে দই খুবই পরিচিত একটি খাবার। দই-এ প্রোটিন, ভিটামিন বি৬, ভিটামিন১২, রিবোফ্লাবিন,ক্যালসিয়াম, ফসফরাস, ফ্যাট ইত্যাদি পাওয়া যায় যেগুলো মানবদেহের জন্যে অত্যন্ত উপকারী। টক দই নিয়ে গবেষনা করে পাওয়া গেছে যে, দই-এ উপস্থিত উপকারী ব্যাকটেরিয়া দেহকে ক্ষতিকর পদার্থমুক্ত রাখে ও ক্যান্সার প্রতিরোধ করে।
টক দই খাওয়ার উপকারিতা
দুধের পুষ্টিসমৃদ্ধ একটি খাবার টক দই। কিছু কিছু ক্ষেত্রে দুধের থেকেও বেশি পুষ্টি উপাদান থাকে টক দই এ যেমন দুধের থেকে টক দই এ ক্যালসিয়াম বেশি থাকে । অনেকেই দুধ খেয়ে সহ্য করতে পারে না। এলার্জি হয় কিংবা ডায়রিয়া হয়ে যায়। তারা অনায়াসে টক দই খেতে পারেন কারন দুধে যেসব উপাদানের জন্যে ডায়রিয়া হয় টক দই-এ সেসব উপাদান থাকে না।
দুধে যে ল্যাক্টোজ থাকে দই এ সেই ল্যাক্টোজ ল্যাকটিক এসিডে পরিনত হয়। ল্যাকটিক অ্যাসিডের ব্যাকটেরিয়া গাঁজন প্রক্রিয়ার সময় দুধের জমাট বাঁধে এবং দই তৈরি করে। টক দই এর উপকারিতাঃ
প্রোবায়োটিক
বিজ্ঞনীরা গবেষনা করে পেয়েছেন যে, এ দই এ এমন সব উপকারী ব্যাকটেরিয়া আছে যেগুলো আপনার শরীরে ক্ষতিকর ব্যাকটেরিয়াকে থাকতে দেয় না। টক দই এই বায়োঅ্যাকটিভ ব্যাকটেরিয়াগুলোর মাধ্যমে শরীরকে নানা রকম রোগ ব্যাধি থেকে রক্ষা করে। এখানে উপস্থিত ব্যাকটেরিয়াগুলোকে চাইলে অন্য কিছুতেও যোগ করা যায়।
হাঁড় ও দাঁত
টক দই তে প্রচুর ক্যালসিয়াম পাওয়া যায়। মানব দেহের হাঁড় ও দাঁতের জন্যে ক্যালসিয়াম অপরিহার্য উপাদান। এর অভাবে হাড়ের কাঠিন্য কম থাকে ফলে সহজেই অস্থি ভেঙে যেতে পারে। দাঁত দিয়ে রক্ত পোড়া, দাঁতে শক্তি কম থাকলে দাঁত পড়ে যায়, কিংবা আংশিক ভেঙে যায়। টক দই এর অন্যান্য ভিটামিন ও খনিজগুলো গুচ্চভাবে এ সমস্যা কমাতে সাহায্য করে। এছাড়া ক্যালসিয়ামের অভাবে শরীরের বিভিন্ন অস্থি সন্ধি বা জোড়ার ব্যথাসহ, আথ্রাইটিস, বা যেকোনো বাতের ব্যথাই দূর করে টক দই ।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
কন্সটিপেশন বা কোষ্ঠকাঠিন্য এমন একটা রোগ যে রোগ অন্য কতগুলো রোগকে আমন্ত্রন করে। এর কারনে গ্যাস্ট্রিক বা এসিডিটির সমস্যা, আলসার, পেটে ব্যথা, এপেনডিসাইটিস ইত্যাদির সমস্যা হতে পারে । কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিতসায় বাজারে অনেক মেডিসিন পাওয়া গেলেও দীর্ঘমেয়াদে খেলে এসব মেডিসিনের সাইড ইফেক্টে অন্য সমস্যাও হয়। টক দই এ ল্যাকটিক এসিড থাকে। এই ল্যাকটিক এসিড কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে। আর টক দই যেহেতু কোনো মেডিসিন না, তাই এটি খেলে অন্য সমস্যা হবারও চান্স নেই।
উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রনে
টক দই উচ্চ রক্তচাপ কমাতে সাহায্য করে। আমাদের দেশে এখনও কারও ব্লাড প্রেসার বেড়ে গেলে টক খাওয়ার প্রচলন আছে। সে অনুযায়ীই দেখা গেছে টক দই উচ্চ রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করতে পারে । ব্লাড প্রেসার বেশি থাকার অন্যতম কারন হলো রক্তে উচ্চ মাত্রার কোলেস্টেরল। টক এসব চর্বির পরিমান কমিয়ে শরীরকে হার্ট এটাক, স্ট্রোক, উচ্চ রক্তচাপের সমস্যাগুলো নিয়ন্ত্রনে রাখে।
রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে
এই ধরনের দই এ ভিটামিন এ, জিঙ্ক, পটাসিয়াম, সেলেনিয়াম, আয়োডিন এবং ক্যালসিয়াম সহ বিভিন্ন ধরণের পুষ্টি, ভিটামিন এবং সক্রিয় উপাদান থাকতে পারে যা ইমিউন সিস্টেমের কাজ করার জন্য প্রয়োজন। রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা যার যত বেশি তার রোগ তত কম হয়। আমরা এই করোনার মধ্যে দেখেছি রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বেশি থাকাটা কত প্রয়োজন। করোনায় দুর্বল রোগ প্রতিরোধ সম্পন্ন লোকেদের বেশি বাজে অবস্থা হয়। অপর দিকে স্ট্রং ইমিউন সিস্টেম থাকা ব্যক্তিদের তেমন কিছুই হয় না।
শরীর টক্সিন মুক্ত করতে
গবেষণায় দেখা গেছে যে টক দই লিভার এবং অগ্ন্যাশয়ের কাজকে উদ্দীপিত করে, এইভাবে শরীর থেকে আরও বিষাক্ত পদার্থ দূর করতে সাহায্য করে। এছাড়াও এটি কোষ থেকে দূষিত ও বিষাক্ত পদার্থ বের করে শরীরকে বিভিন্ন মারাত্বক রোগ গুলোর থেকে রক্ষা করে।
কোলেস্টেরল নিয়ন্ত্রন করে
গবেষণায় দেখা গেছে যে টক দই নিয়মিত খেলে টোটাল কোলেস্টেরলের মাত্রা কমে। যা হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে, হার্ট অ্যাটাক এবং স্ট্রোকের ঝুঁকি কমায়। মানবদেহে একই সাথে ভালো কোলেস্টেরল ও খারাপ কোলেস্টেরল দুটোই থাকে। এর মধ্যে ভালো কোলেস্টেরল মানুষের স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী ও সৌন্দর্যবর্ধক, আর খারাপ কোলেস্টেরল প্রচন্ড রকমের অপকারী ও মৃত্যু ঝুকির কারন হয়। টক দই একই সাথে ভালো কোলেস্টেরল বৃদ্ধি ও খারাপ কোলেস্টেরল হ্রাস করে।
ওজন কমাতে
টক দই দেহের অতিরিক্ত ওজন কমাতে সাহায্য করে। টক দই এ থাকা আমিষ ক্ষুধা হ্রাস করে শরীরে ওজন কমায়। এটি যেহেতু কোলেস্টেরল এর মাত্রা কমিয়ে আনে, তাই মেদ কমাতে এটি সাহায্য করে।
দুধ থেকে দই তৈরির পদ্ধতি
দুধ থেকে দই তৈরি করা শুধু বানিজ্যিক উদ্দেশ্যে না আমাদের দেশে হোমমেইড দই তৈরি করে অনেক মহিলারা বাসায় খাওয়ার জন্যে। অনেকে এখন এটি বাসায় তৈরি করে অনলাইনে সেল করেও স্বাবলম্বী হচ্ছে। দুধ থেকে দই তৈরি খুব সহজ প্রক্রিয়া। সংক্ষেপে তুলে ধরা হলোঃ
স্টেপ-১ঃ
দুধ ১৮০ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত ফুটানোঃ এটি আপনার দুধের মধ্যে লুকিয়ে থাকা ক্ষতিকর জীবাণুগুলিকে মেরে ফেলে এবং নিশ্চিত করে যে দুধে কোনও অবশিষ্ট ব্যাকটেরিয়া, প্যাথোজেন, ছাঁচ বা স্পোর নেই ৷
স্টেপ-২ঃ
দুধকে ১১২-১১৫ ডিগ্রী ফারেনহাইট পর্যন্ত ঠান্ডা করে নেয়াঃ দুধকে খারাপ জীবানু থেকে মুক্ত করার জন্য গরম করা হয় তেমনি ভালো ব্যাকটেরিয়ার এটাকে ঠান্ডা করে নিতে হবে। আপনার দুধ গরম করার সময় আপনি যে ইন্সট্যান্ট রিড থার্মোমিটার ব্যবহার করেছিলেন তা 112-115 ডিগ্রীতে কখন ঠান্ডা হয় তা জানতে ব্যবহার করুন।
স্টেপ-৩ঃ
স্টার্টার যোগ করাঃ এক কাপ উষ্ণ দুধ ঢালুন এবং একটি দই স্টার্টার ( ইয়োগুরমেট ব্যবহার করতে পারেন) বা 3 টেবিল চামচ আগে থেকে তৈরি দই দিয়ে নাড়ুন। একটি ভাল স্টার্টারের জন্য, ল্যাকটিক অ্যাসিড গঠনকারী ব্যাকটেরিয়া সন্ধান করুন। ন্যূনতম আপনাকে নিতে হবে ল্যাকটোব্যাসিলাস বুলগারিকাস এবং স্ট্রেপ্টোকক্কাস থার্মোফিলাস । অন্যান্য ভাল ব্যাকটেরিয়া হল ল্যাকটোব্যাসিলাস অ্যাসিডোফিলাস এবং বিফিডোব্যাকটেরিয়াম ল্যাকটিস।
স্টেপ-৪ঃ
বাকি দুধ দিয়ে দই স্টার্টার নাড়ুনঃ এটি সমস্ত দুধে ভাল ব্যাকটেরিয়া ছড়িয়ে দেয়।
স্টেপ-৫ঃ
জারে দুধ ঢালা এবং 7-9 ঘন্টার জন্য ইনকিউভেট করাঃ একটি সামঞ্জস্যপূর্ণ তাপমাত্রা ভাল ব্যাকটেরিয়ার জন্য স্বর্গ এবং তাদের বৃদ্ধিকে উৎসাহিত করে। আপনি যত বেশি সময় আপনার দইটি ছেঁকে দেবেন তত ঘন হবে। এবং প্রায় 8 ঘন্টা পরে, আপনি সুস্বাদু, স্বাস্থ্যকর, ঘন এবং ক্রিমযুক্ত দই পাবেন।
স্টেপ-৬ঃ
জারটি ফ্রীজে রেখে ঠান্ডা করুনঃ দইকে কয়েক ঘণ্টা ফ্রিজে রেখে ঠান্ডা করুন। দই যত ঠান্ডা হবে তত ঘন হয়ে যাবে।
দই খাওয়ার উপকারিতা
দই পুষ্টিগুণে সমৃদ্ধ এবং নিয়মিত খাওয়া হলে তা শরীরকে স্বাস্থ্যবান করে তোলে। এটি কিছু রোগের ঝুঁকি কমাতে সাহায্য করতে পারে, পাশাপাশি হজমের স্বাস্থ্য এবং ওজন নিয়ন্ত্রণেও সাহায্য করে। দই এর যেহেতু অনেক ধরন আছে তাই সর্বাধিক স্বাস্থ্য সুবিধার জন্য, প্রোবায়োটিক ধারণ করে এমন সরল, মিষ্টিহীন জাতগুলি বেছে নিন।
এক কাপ দই দিনের মোট ক্যালসিয়ামের চাহিদার ৪৯শতাংশ পূরন করে। অস্টিওপোরেসিসের সমস্যা দই উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে। শক্তিশালী পরিপাক তন্ত্র গঠন করে,এর মধ্যে উচ্চ মানের আমিষ থাকে যা রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বৃদ্ধি করে। এছাড়া দই শরীরের ওজন ঠিক রাখতে ও হার্ট ভালো রাখতে সাহায্য করে।
বাড়িতে দই বানানোর রেসিপি
বাড়িতে দই বানানোর জন্যে অনেক ধরনের রেসিপি হয় । তবে এখানে আমরা যেহেতু টক দই (tok doi recipe) নিয়ে কথা বলছি তাই টক দই নিয়ে কয়েক ধরনের রেসিপির কথা বলা যাক যেমনঃ পাউডার দুধ দিয়ে টক দই, গরুর দুধ দিয়ে টক দই, লেবু বা তেতুল দিয়ে টক দই রেসিপি এছাড়া ভিনেগার দিয়েও খুব দ্রুত টক দই রেসিপি তৈরি করা যায়।
ভিনেগার দিয়ে টক দই বানানোর পদ্ধতি
ভিনেগার দিয়ে টক দই বানানোর ক্ষেত্রে গরুর দুধ বা গুড়ো দুধ যেকোনোটাই ব্যবহার করা যায়। দুধকে গরম করে ঘন করে নিতে হবে এরপর গরম দুধ ঠান্ডা করে নেয়ার জন্যে রেখে দিতে হবে কিছুক্ষন । কুসুম গরম থাকা অবস্থায় এর মধ্যে ভিনেগার দিয়ে দিতে হবে। এক কাপ দুধে ২ চামুচ ভিনেগার দিলেই হবে। দেওয়ার কিছুক্ষনের মধ্যেই দেখা যাবে দুধ জমতে শুরু করেছে। এভাবে কিছুক্ষন রেখে দিলেই দুধ জমে দই হয়ে যাবে। এরপরে আরো ঠান্ডা ও ঘন করার জন্যে দই ফ্রীজে রেখে দিন।
টক দই এর অপকারিতা
দই এর কিছু কিছু ধরনের অপকারিতা থাকলেও সত্যিকারে টক দই এর তেমন কোনো অপকারিতা নেই। তবে চিনি মেশালে এ দই হয়ত কিছু গুনাগুন হারাবে ও কিছুটা ক্ষতিকর হতে পারে ডায়াবেটিস রুগীদের জন্যে। এছাড়া টক দই তেমন ক্ষতিকর উপাদান নেই।