বিভিন্ন খেজুর ও খেজুরের উপকারিতা

বিভিন্ন খেজুর ও খেজুরের উপকারিতা

বিভিন্ন খেজুর ও খেজুরের উপকারিতা

খেজুর আমাদের দেশে খুবই পরিচিত একটি ফল। খেজুর মধ্যপ্রাচ্যে হাজার হাজার বছর ধরে প্রধান খাদ্য হিসেবে  ব্যবহৃত হয়ে আসছে । খেজুরের উপকারিতা অনেক বেশি আর খেজুর খেতে খুবই সুস্বাদু হওয়ার কারনে সারা বিশ্বেই এটি বেশ জনপ্রিয়। খেজুরে এন্টি ইনফ্লামেটরি,

এন্টি অক্সিডেন্ট ও এন্টি টিউমার বৈশিষ্ট্যের কারনে এর স্বাস্থ্য উপকারিতা এত বেশি যে বিভিন্ন ধর্মেও এই ফলকে পথ্য হিসেবে উল্লেখ করা হয়েছে।

 

খেজুর কি 

খেজুর(khejur) হলো এক ধরনের ফল। ইংরেজিতে এটি Date Palm নামে পরিচিত । খেজুর গাছ(বৈজ্ঞানিক নামঃ Phoenix dactylifera) থেকে খেজুর ফল হয়। এ গাছটি তাল জাতীয় ও শাখাবিহীন। এটি মরুভূমিতে সবচেয়ে ভালো জন্মায় বলে সারা বিশ্বের মোট খেজুর উৎপাদনের সিংহভাগ-ই উৎপন্ন হয় আরব ও আফ্রিকার দেশগুলোতে । তবে খেজুর গাছের সৌন্দর্যের কারনে বিশ্বের বহুদেশে গুরত্বপূর্ণ স্থাপনা, প্রতিষ্ঠানের সামনে এ গাছ দেখতে পাওয়া যায়। শাখাবিহীন সারিবদ্ধভাবে এ গাছগুলো দেখে মানুষ মুগ্ধ হয়। গাছটি সাধারনত ১৫ থেকে ৩০মিটার এর মতো লম্বা হয়। খেজুর গাছের রস আমাদের দেশে খুবই প্রিয় একটি খাবার । এর থেকে খেজুরের গুড় তৈরি করা হয়।

 

খেজুরের পুষ্টি উপাদান

খেজুর পুষ্টি উপাদানে ভরপুর একটি ফল। USDA Food Data central এর তথ্য অনুযায়ী খেজুরের মধ্যে প্রোটিন,শর্করা, স্নেহ পদার্থ, ভিটামিনের মধ্যে ভিটামিন এ, বি১,বি২,বি৬, সি,ই  ও ভিটামিন কে থাকে। খনিজ উপাদানের মধ্যে খেজুরে ক্যালসিয়াম, পটাশিয়াম, আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম, ম্যাঙ্গানিজ, সোডিয়াম, জিংক ও পানি থাকে। এসবের প্রত্যেকটি উপাদান মানব দেহের জন্যে খুবই উপকারী । গবেষক চিং ইয়ং লি ও মোহম্মদ আলী আল ফারসি র খাদ্য ও পুষ্টি বিজ্ঞান এর উপর প্রকাশিত একটি যৌথ জার্নালে বলা হয়েছে, তামা, পটাশিয়াম, ম্যাগনেশিয়াম, সেলেনিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় খনিজগুলোর দৈনিক চাহিদার প্রায় ১৫% পূরন করা সম্ভব শুধু দৈনিক ৪টা খেজুর খাওয়ার মাধ্যমে।

সবচেয়ে বেশি খেজুর উৎপন্ন করে যে দেশ

খেজুর বিশ্বের প্রায় সব দেশে  উৎপন্ন হলেও আফ্রিকা ও মধ্যপ্রাচ্যের দেশগুলোতেই সবচেয়ে বেশি উৎপন্ন হয়। ২০১৭ সালের করা সার্ভে অনুযায়ী খেজুর উৎপাদনে শীর্ষে অবস্থান করছে আফ্রিকার দেশ মিশর। এরপরেই আছে সৌদি আরব, ইরান, আলজেরিয়া। আমাদের প্রতিবেশি দেশ পাকিস্তান খেজুর উৎপাদনে ষষ্ঠ অবস্থানে আছে। আমাদের দেশে খেজুর উৎপন্ন হলেও বানিজ্যিকভাবে সেরকম খেজুর উৎপন্ন হয় না। 

 

বিভিন্ন জাতের খেজুর 

খেজুর অনেক রকমের হয়। আমাদের দেশে বিশেষ করে গ্রামাঞ্চলে একধরনের খেজুর হয় যেগুলো বানিজ্যিকভাবে চাষ হয় না । প্রাকৃতিকভাবে তৈরি হওয়া খেজুর গাছে এগুলো হয়ে থাকে। আবার রমজান মাসে আমরা যেরকম খেজুর খাই সেগুলো কিন্তু সবই প্রায় আমদানি করা । আমাদের দেশে আমরা বেশিরভাগ আজওয়া খেজুর, খুরমা(khurma khejur) খেজুর, মরিয়ম খেজুর(moriom khejur) ইত্যাদি বেশি খেয়ে থাকি। এই খেজুরগুলো আমাদের দেশে শুকনো করেই পাঠানো হয়। এসব শুকনো  খেজুরের উপকারিতা অনেক। সৌদি আরবে পাওয়া যায় এমন আরো খেজুরের মধ্যে শালাবি, সুক্কারি,খুদরি, ওয়াসালি, মাবরুম ইত্যাদি। এগুলো কেজি দরে বাংলাদেশি টাকায় ২০০ থেকে ৩০০০টাকা পর্যন্ত হতে পারে। 

 

খেজুরের উপকারিতা

খেজুর স্রষ্টার এক অশেষ নেয়ামত বা উপহার। স্বাদে পুষ্টিতে এই ফল অনন্য। একাধিক ধর্মে এই ফল খেতে উৎসাহিত করা হয়েছে। এখন চলুন আমরা জেনে নিই খেজুর খাওয়ার উপকারিতা কি কি

 

শক্তির উৎস

খেজুরে গ্লুকোজ, সুক্রোজ, ফ্রুক্টোজ এর মতো প্রাকৃতিক শর্করাগুলো বেশি থাকে । এই শর্করার মধ্যে থাকে উচ্চ শক্তি। সারাবিশ্বে দ্রুত ক্লান্তি কাটানো ও শক্তি ফিরে পেতে হালকা নাস্তা হিসেবে খেজুর খাওয়ার প্রচলন রয়েছে। ইন্টারন্যাশনাল জার্নাল অফ ফুড সায়েন্সে এন্ড নিউট্রিশন এ প্রকাশিত গবেষনায় বলা হয়েছে যে, পরিশ্রম করে আপনি যখন ক্লান্ত থাকবেন তখন এই পুষ্টিসমৃদ্ধ খেজুর আপনাকে শক্তি ফিরে পেতে সাহায্য করবে । মুসলিমরা রমজানের সময় সারাদিন উপবাস করে ইফতারি করার সময় খেজুর খায় এতে শরীরে দ্রুত শক্তি ফিরে আসে।

 

ব্রেইন সতেজ রাখতে

খেজুর মস্তিষ্ককে শানিত রাখে । একটি গবেষনায় দেখা যায়, খেজুর মস্তিষ্ককে অক্সিডেটিভ স্ট্রেস ও প্রদাহ থেকে রক্ষা করতে পারে । গবেষনা মতে, খেজুর ফাইবারের বড় উৎস এবং এর মধ্যে এন্থোসায়ানিন, ফিরুলিক এসিড, প্রোটোক্যাচুইক এসিড এবং ক্যাফেইক এসিড এর মতো এন্টি অক্সিডেন্ট থাকে যেগুলো আলঝেমিয়ারস ডিজিজ ও ডিমেনশিয়া রোধ করে । 

 

কোষ্ঠ্যকাঠিন্য দূর করে

 

তিউনিসিয়ায় একটি ঐতিহ্যবাহী চিকিৎসা ছিল যেখানে খেজুরকে কোষ্ঠ্যকাঠিন্যের ঔষধ হিসেবে ব্যবহার  করা হতো । ১০০ গ্রাম মেজুল খেজুরের মধ্যে প্রায় ৬.৭গ্রাম ডায়েটারি ফাইবার থাকে । এই ফাইবার হজমকে সহজ করে দেয় । ফলে কন্সটিপেশন কমে যায়। তবে এটার জন্যে খেজুরগুলোকে সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রাখুন এবং পরে এগুলো কোনো তরলসহ পেস্ট বানিয়ে খালি পেটে খেলেই সমস্যার সমাধান হয়ে যাবে।

 

পেটের পীড়া দূর করে

খেজুরে দ্রবনীয় ও অদ্রবনীয় অনেক ফাইবার রয়েছে, সাথে আছে অনেক উপকারী এমাইনো এসিড যেগুলো হজম প্রক্রিয়া ত্বরান্বিত করে। এছাড়া গবেষনায় পাওয়া যায়, খেজুর গ্যাস্ট্রোইসোফেজিয়াল রিফ্লাক্স ডিজিজ, ডাইভারটিকুলাইটিস এবং হেমোরয়েডস এর মতো রোগ গুলাতেও পথ্য হিসেবে কাজ করে। 

 

রক্তস্বল্পতা দূর করে

আপনার যদি একাদারে মাথা ব্যথা, মাথা ঘোরা, শ্বাস প্রশ্বাসে সমস্যা, ক্লান্তি, ভঙ্গুর নখ ইত্যাদি সমস্যাগুলো থাকে তাহলে হয়ত আপনি এনিমিয়া বা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন। আয়রন হলো এই রক্তস্বল্পতা দূর করার মহৌষধ। খেজুরে প্রচুর পরিমানে আয়রন থাকে যা এনিমিয়া দূর করতে সক্ষম । 

 

হৃদরোগ প্রতিরোধ করে

জার্নাল অফ এগ্রিকালচার এন্ড ফুড ক্যামিস্ট্রি র গবেষনায় পাওয়া যায়, খেজুর ট্রাইগ্লিসারাইড ও অক্সিডেটিভ স্ট্রেস এর লেভেল কমাতে কার্যকর। এ দুটোই হৃদরোগ ও এথেরোজেনেসিসের ঝুকির কারন যা ধমনীতে ফ্যাটি প্লেক তৈরী করে। লাখ লাখ টাকা খরচ করে ওপেন হার্ট সার্জারি করে আমাদের এসব হার্ট ব্লক দূর করতে হয়। অনেকে ধমনীর এসব ব্লকের কারনে হঠাৎ হার্ট এটাক করে মারাও যায়। ওজন কমাতে খেজুরের উপকারিতা রয়েছে।

 

সিজনাল ফ্লু উপশম করে

খেজুর সিজনাল এলার্জিক রাইনাইটিস(SAR) দূর করে । শুধু মার্কিন যুক্তরাষ্ট্রেই প্রায় ৩০ মিলিয়ন মানুষ এলার্জিক রাইনাইটিসে ভুগে। ইনফ্ল্যামেটরি রিসার্চের প্রকাশিত গবেষনায় দেখা যায় খেজুরের ইমিউনো থেরাপি এলার্জিক রাইনাইটিস রোগীদের প্রদাহের বিভিন্ন মার্কার কমাতে কার্যকর ছিল। 

 

খেজুর খাওয়ার নিয়ম

খেজুর যেকোনো সময় খাওয়া যায়। তবে সকালে খেজুর খেলে এটি সারাদিন শরীরে শক্তি জোগায়। খেজুর সারারাত পানিতে ভিজিয়ে রেখে সকালে খালি পেটে খেলে পেট পরিষ্কার থাকবে। খেজুরের পেস্ট বানিয়ে সেটি দুধ ও দইয়ের সাথে মিশিয়ে খাওয়া যায়। ডেট কেক, বিভিন্ন ফেস্টিবল কেক এর মধ্যে খেজুরের পেস্ট ব্যবহার করা হয়। সকালে নাস্তায় রুটির সাথে খেজুর পেস্ট খাওয়া যায়। আজওয়া খেজুর খাওয়ার নিয়ম একই। 

 

খেজুরের ধর্মীয় তাৎপর্য 

ইসলামে ধর্মে খেজুরকে বিশেষভাবে মুল্যয়ন করা হয়েছে । পবিত্র কুরআনে ২৬ বার খেজুর ফলটির কথা বলা হয়েছে। হযরত ঈসা (আঃ) এর জননী মরিয়ম(রাঃ)  যখন প্রসব বেদনায় কাতরাচ্ছিলেন তখন তিনি খেজুর খেয়েছিলেন এতে তাঁর প্রসব বেদনা লাঘব হয়। আমাদের প্রিয় নবী সব সময় সাতটি খেজুর দিয়ে সকালের নাস্তা করতেন ও সবাইকে খেজুর দিয়ে ইফতার করতে বলতেন। ইসলাম ধর্ম ছাড়াও খ্রীস্টান ও ইহুদী ধর্মেও খেজুরের বিশেষ মর্যাদা রয়েছে ।

 

পরিশেষে

খেজুর অত্যন্ত উপকারী ও পবিত্র একটি ফল। ডায়াবেটিস রোগীদের ক্ষেত্রেও এর মিষ্টি স্বাদ তেমন ক্ষতি করে না। খেজুরের অপকারিতা নেই, শুধু ডায়াবেটিস রুগীদের ক্ষেত্রে একটু সতর্কতার সাথে খেলেই হয় । খেজুরে কল্যান রয়েছে যা একাধিক ধর্ম অনুযায়ী ও বৈজ্ঞানিকভাবে প্রমানিত হয়েছে । 

 

Leave a Reply

Your email address will not be published. Required fields are marked *

Main Menu