বিট লবন কি? বিট লবনের উপকারিতা
বিট লবন কি? বিট লবনের উপকারিতা
লবন সাধারনত মসলা হিসেবেই খাবারে ব্যবহৃত হয়। এটি খাবারের স্বাদ বৃদ্ধি করে। লবন ছাড়া খাবারে পরিপূর্ন স্বাদ পাওয়া যায় না। লবন বেশির ভাগই তৈরি হয় সমুদ্রের পানি থেকে। পৃথিবীর সব জায়গায় লবন তৈরি ও ব্যবহার করা হয়। রাসায়নিকভাবে লবনের প্রধান উপাদান হলো সোডিয়াম ক্লোরাইড। লবনের অনেক প্রকার আছে যেমনঃ আয়ডিনযুক্ত লবন, পিংক সল্ট, বিট লবন, পকিং লবন, রক লবন ইত্যাদি। কাঁচা লবন খাওয়ার ক্ষেত্রে কিছু বিধি নিষেধ আছে সত্যি কিন্তু একেবারে লবন না খাওয়া স্বাস্থ্যের পক্ষে ক্ষতিকর। আজকের আর্টিকেলে আলোচনা করব বিট লবন নিয়ে যেখানে থাকবে বিট লবন কি? বিট লবনের উপকারিতা ও অপকারিতা, বিট লবনের রাসায়নিক গঠন।
বিট লবন কি?
বিট লবন এক ধরনের লবন। ইংরেজিতে একে ব্লাক সল্ট বলা হয়। হিন্দিতে বলে কালা নমক। হিমালয় থেকে এটি পাওয়া যায় বলে একে হিমালয়ান সল্টও বলা হয়। এই কালা নমক আয়ুর্বেদিক শাস্ত্রের একটি গুরুত্বপূর্ন উপাদান। প্রাচীনকাল থেকে ভারতীয়রা ‘কালা নামক’ শরীরের জন্য থেরাপিউটিক উপকারিতা হিসেবে বিবেচনা করে আসছে। কালো লবণ স্বাস্থ্যের জন্যে উপকারী বলে মনে করা হতো। এখনও এটি কেবল ভারত উপমহাদেশের কয়েকটি দেশ যেমন বাংলাদেশ, ভারত, নেপাল ও পাকিস্তানে এটি পাওয়া যায়। খাবারে মসলা হিসেবে স্বাদ বৃদ্ধির জন্যে বিট লবন ব্যবহার করা হয়।
বিট লবনের উপাদান
খাবার লবনের মতো বিট লবনের প্রধান উপাদান সোডিয়াম ক্লোরাইড, যদিও এটি খাবার লবনের মতো সাদা ও ছোট ছোট দানাদার নয়। কারন বিট লবনে সোডিয়াম ক্লোরাইড ছাড়াও সোডিয়াম সালফেট, সোডিয়াম সালফাইড, ফেরাস সালফাইড থাকে। সালফার ও আয়রন সালফাইডের মতো রঙিন যোগের কারনে বিট লবন সুগন্ধী ও রঙিন হয়।
বিট লবনের উপকারিতা
খনিজ থেকে তৈরি এ লবনের খনিজ উপাদান স্বাস্থ্যের জন্যে অত্যন্ত উপকারী । বিটা লবন বা ব্লাক সল্টের স্বাস্থ্য উপকারিতা সাধারন লবন থেকে অনেক বেশি। 2,000 বছরেরও বেশি ইতিহাস সহ সুপরিচিত ভারতীয় চিকিৎসা পদ্ধতি আয়ুর্বেদে বিট লবণের একটি উল্লেখযোগ্য স্থান রয়েছে। আয়ুর্বেদিক চিকিতসকগন বিশ্বাস করেন যে কালা নমক লবণের বিভিন্ন ধরনের ঔষধি গুণ রয়েছে।
তারা এটিকে হজমের ব্যাধি, চোখের রোগ, দাঁতের সমস্যা, স্ট্রেস-সম্পর্কিত অসুস্থতা, অ্যানিমিয়া এবং হিস্টিরিয়া নিরাময়ে ব্যবহার করে । গবেষণায় দেখা গেছে যে, বিট লবণের কিছু ঔষধি উপকারিতা রয়েছে। হিমালয় কালো লবণে প্রচুর পরিমাণে অ্যান্টিঅক্সিডেন্ট রয়েছে এবং এতে কম সোডিয়াম রয়েছে।
হজমে সহায়ক
বিট লবন বা কালো লবণ লিভারে পিত্ত উৎপাদনে সাহায্য করে । এই পিত্তরস হজমে সাহায্য করে। এটি ছোট অন্ত্রে সংঘটিত শোষণ প্রক্রিয়াগুলোকে উন্নত করতে সাহায্য করে। ফলে হজম প্রক্রিয়া বাধাগ্রস্ত হয় না বরং ত্বরান্বিত হয়, অম্বল এবং পেট ফোলাভাব কমে। এটি অ্যাসিড, গ্যাস এবং পেট ফাঁপা কমায় এবং রিফ্লাক্স থেকে মুক্তি দেয় এবং অন্ত্রে ভিটামিন শোষণ বাড়ায়।
পেশীর খিঁচুনি প্রশমিত করে
পেশিতে খিচুনি একটি অস্বস্তিদায়ক রোগ ।এর কারনে স্বাভাবিক জীবন যাপনে অনেক ব্যঘাত ঘটে। বিট লবনে প্রচুর পরিমাণে পটাসিয়াম রয়েছে। পটাসিয়াম পেশীর খিঁচুনি কমাতে সাহায্য করে এবং তাদের সঠিকভাবে কাজ করতে সাহায্য করে।
হার্টের স্বাস্থ্য ভালো রাখে
বিট লবণ রক্ত পাতলা করতে সাহায্য করে এবং কোলেস্টেরলের মাত্রা কমায়। তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ বা হার্টের সমস্যা আছে তাদের জন্যে এটি পরিমিত মাত্রায় সহায়ক। রক্ত পাতলা করার জন্যে এখন বাজারে কয়েক ধরনের দামি ঔষধ পাওয়া যায় যেগুলো যথেষ্ট দামী। তবে উচ্চ রক্তচাপের ব্যক্তিদের প্রচুর পরিমাণে বিট লবণ খাওয়া উচিত নয় (প্রতিদিন 3.75 গ্রামের বেশি নয়)।
পুষ্টি প্রদানকারী
আয়রন, ম্যাগনেসিয়াম এবং এমনকি ক্যালসিয়ামের মতো প্রয়োজনীয় খনিজ সরবরাহ করে কালা নামক মানব দেহের পুষ্টি উপাদানের চাহিদা পূরন করে । বিট লবনে উপস্থিত এ খনিজগুলোর অভাবে মানবদেহে নানা ধরনের রোগ হয়। এটিতে কম সোডিয়াম থাকায় তা স্বাস্থ্যের আরও ভালো উপকার করে।
ফোলাভাব কমায়
যারা প্রায়ই ফোলাভাব এবং বুকজ্বালা অনুভব করেন তাদের প্রতিদিনের খাদ্যতালিকায় ‘কালা নামক’ অন্তর্ভুক্ত করা উচিত। কারণ বিট লবণ অ্যাসিডের মাত্রা নিয়ন্ত্রণের পাশাপাশি রিফ্লাক্স সমস্যা নিয়ন্ত্রণে সাহায্য করে।
ওজন কমায়
বিট লবনের রাসায়নিক উপাদান শরীরের অতিরিক্ত মেদ কমাতে ও ওজন কমাতে সাহায্য করে। ওজন কমানোর জন্য বিট লবণ আপনার ডায়েটে একটি চমৎকার সংযোজন যখন আপনি আপনার সোডিয়াম গ্রহণ কমাতে চান । কারন বিট লবনে সোডিয়ামের মাত্রা কম থাকে অন্য লবন থেকে।
কোষ্ঠকাঠিন্য দূর করে
বিট লবণ আপনার গ্যাস্ট্রোইনটেস্টাইনাল সিস্টেমে ইতিবাচক প্রভাব রাখে । আয়ুর্বেদ শাস্ত্রে কোষ্ঠকাঠিন্যের চিকিৎসার জন্যে বিট খেতে পরামর্শ দেয়া হয়। এটি দ্রুত এবং সহজ ঘরোয়া প্রতিকার হিসেবে খাওয়া যায় । বিট লবনের সাথে আদা এবং লেবুর রস মিশিয়ে খেলে বাড়তি উপকার পাওয়া যায়।
ত্বকের যত্নে
বিট লবণ ত্বকের জন্য উপকারী। এর প্রয়োজনীয় খনিজ উপাদান ত্বকের জন্য উপকারী। যদি আপনার ত্বক ফাটা থাকে তবে আপনি হালকা গরম পানিতে বিট লবণ যোগ করতে পারেন এবং আক্রান্ত স্থান ভিজিয়ে রাখতে পারেন। এটি আপনার ফাটা ত্বককে নিরাময় করতে সাহায্য করবে।
বিট লবণের পানি, বিট লবণ দিয়ে তৈরি মলম, সাবান তৈলাক্ত ফেইস, ব্রণ-প্রবণতা এবং দাগযুক্ত ত্বক পুনরুদ্ধার করতে সহায়তা করে। এছাড়াও বিট লবণের দানা দিয়ে তৈরি স্ক্রাব জেল এবং ক্রিমগুলি থেকে ইতিবাচক প্রতিক্রিয়া পাওয়া যায় যা ত্বক পরিষ্কার ও ফর্সা করার জন্যে পণ্যগুলিতে যোগ করা হয়।
চুলের যত্নে
কালো লবণে খনিজ উপাদান রয়েছে যা চুলের বৃদ্ধি করতে পারে। কালা নামক যখন শ্যাম্পু, হেয়ার ক্রিম বা হেয়ার মাস্কে প্রয়োগ করা হয়, তখন সেটি দুর্বল চুলকে মজবুত করে এবং বিভক্ত হওয়া থেকে রোধ করে। এটি খাবারের সাথে খাওয়ার সময় চুল পড়া এবং খুশকি উল্লেখযোগ্যভাবে কমিয়ে আনে।
সাইনোসাইটিস কমায়
যাদের শ্বাসকষ্ট বা সাইনোসাইটিস আছে তারা সেটি নিরাময়ে ‘কালা নামক’ ব্যবহার করতে পারেন। গরম পানিতে কালো লবণ যোগ করে বাষ্প নিলে ও গার্গল করলে সেটি আপনার কফ পরিষ্কার এবং নাকের ছিদ্র খোলার গতি বাড়াতে পারে ও শ্বাসকষ্ট নিরাময় করতে পারে।
বিট লবনের উপকারিতা নিয়ে মোটামুটি আলোচনা শেষে এবার আমরা আলোচনা করবো লবনের উপকারিতা ও কয়েকটি লবন নিয়ে।
লবনের উপকারিতা
লবন শরীরে আয়োডিনের অভাব দূর করে। আয়োডিনের অভাবে মানুষের গলগন্ড রোগ হয়। আগের দিনে এই রোগটি অনেক কমন থাকলেও বর্তমানে আয়োডিনযুক্ত লবন খাওয়ার কারনে এই রোগটির প্রকোপ কমে এসেছে। লবনের খনিজ উপাদান মানব দেহের জন্যে অত্যন্ত উপকারী। লবন মুখের ব্যাকটেরিয়া দূর করতে সাহায্য করে। হাইড্রোক্লোরিক এসিডকে সক্রিয় করে হজমে সহায়তা করে ও অন্ত্রের ক্ষতিকর রোগ জীবানু দমন করে। ডায়রিয়ার সময় শোরীড় থেকে অতিরিক্ত লবন বেরিয়ে যাওয়ার কারনে মানুষ দুর্বল হয়ে যায় এমনকি কিডনি অকেজো মৃত্যু পর্যন্ত হতে পারে। এ অবস্থায় লবনের উপাদান খাবার স্যালাইন খাওয়ানো হয় অথবা শিরাপথে পুশ করা হয়। লবন শরীরে ইলেক্ট্রোলাইটের ভারসাম্য রক্ষা করে। এবার জেনে নিই, হিমালয়ান পিংক সল্ট খাওয়ার নিয়ম সম্পর্কে।
রান্নায় এটি লবণ হিসাবে ব্যবহার করা যায়। হিমালয়ান লবণ মশলাদার মাংসের জন্যও ভাল কারণ এটি পৃষ্ঠের সাথে ভালভাবে আঁকড়ে থাকে এবং সমানভাবে ছড়িয়ে পড়ে। আমেরিকান খাদ্য লেখক এবং উদ্যোক্তা, মার্ক বিটারম্যান কয়েক বছর ধরে ফিনিশিং সল্ট এবং হিমালয় সল্ট নিয়ে ব্লগ লিখছেন । তার বই, সল্ট ব্লক কুকিং-এ তিনি ব্যাখ্যা করেছেন, “হিমালয়ান লবণ ব্লকের খুব কম ছিদ্র থাকে এবং যেহেতু তাদের কার্যত কোন আর্দ্রতা নেই, তাই নিরাপদে উত্তপ্ত করা যেতে পারে বা চরমভাবে ঠাণ্ডা করা যায়।” যদিও গোলাপী হিমালয় লবণের বেশ কিছু খাদ্যতালিকাগত ব্যবহার রয়েছে, এর বাইরে ও পিংক সল্ট এর কিছু ব্যবহার রয়েছে।
এই লবন ত্বকের উন্নতি এবং কালশিটে পেশী প্রশমিত করে।
সল্ট ল্যাম্পগুলি প্রায়শই গোলাপী হিমালয় লবণ দিয়ে তৈরি করা হয় এবং বায়ু দূষণকারী দূর করে। এই বাতিগুলোতে একটি অভ্যন্তরীণ আলোর উৎস সহ লবণের বড় ব্লক থাকে যা লবণকে গরম করে। হিমালয়ান পিংক সল্ট এর দাম কেজি প্রতি ২০০টাকা বা এর আশেপাশে হতে পারে।
সৈন্ধব লবন
সৈন্ধব লবনের ইংরেজি “Sea Salt” । লাল রঙের এই লবনগুলো আকারে বড় বড় দানাদার হয়। নোনা জল বাষ্পীভূত করে এই লবণ তৈরি হয়। সারা বিশ্বের লোকেরা এটি প্রাগৈতিহাসিক কাল থেকে ব্যবহার করে আসছে এবং এটি সাধারণত অনেক রান্নাঘরে পাওয়া যায়।
এর রন্ধনসম্পর্কীয় ব্যবহার ছাড়াও, সৈন্ধব লবণ প্রায়শই বডি স্ক্রাব, স্নান, পানীয় এবং অগণিত অন্যান্য পণ্যগুলিতে যোগ করা হয়।
বিট লবনের অপকারিতা
বিট লবনের উপকারিতা নিয়ে অনেক আলোচনা হলো। তবে এটাও মনে রাখতে হবে বিট লবনের কিছু পাশ্ব প্রতিক্রিয়াও রয়েছে।
বিট লবনে উল্লেখযোগ্য পরিমাণে ফ্লোরাইড থাকে। অত্যধিক ফ্লোরাইড ডেন্টাল ফ্লুরোসিস নামক অবস্থার দিকে নিয়ে যেতে পারে। তাই অতিরিক্ত বিট লবণ খাওয়া থেকে সতর্ক থাকতে হবে।
থাইরয়েড গ্রন্থির সমস্যা করতে পারে। আয়োডিনযুক্ত লবনের পরিবর্তে বিট লবণে খাওয়া যাবে না। আপনার থাইরয়েড গ্রন্থি ভালোভাবে কাজ করার জন্য সঠিক পরিমাণে আয়োডিন প্রয়োজন, যা একা বিট লবণ দিতে পারে না।
অত্যধিক বিট লবণ (প্রতিদিন 6 গ্রামের বেশি) কিডনিতে পাথর তৈরি করতে পারে যা সামনে আরও অনেক স্বাস্থ্য সমস্যা তৈরি করতে পারে।