
শুটকি মাছের উপকারিতা | জেনে নিন শুঁটকি মাছের পুষ্টিগুণ
শুটকি মাছের উপকারিতা সম্পর্কে আজকের পর্বে আলোচনা করবো। আপনারা অনেকেই হয়ত জানেন না যে, বাজারের তাজা মাছের চেয়ে শুটকি মাছে আমিষ, প্রোটিন ও খনিজ লবনের পরিমান বেশি থাকে। শুটকি মাছ উচ্চ প্রোটিনযুক্ত খাদ্য। শুটকি মাছের যে গন্ধ থাকে অনেকেই সেই গন্ধের কারনেই শুটকি মাছ খেতে চায় না আবার অনেকেই এই গন্ধের কারনেই শুটকি মাছ পছন্দ করেন। তো আসুন এখন শুটকি মাছ নিয়ে হালকা ঘাটাঘাটি করে আসি।
বর্তমানে খাদ্য সংরক্ষনের অনেক আধুনিক ব্যবস্থা থাকলেও প্রাচীনকালে এসবের কিছুই ছিল না
তখন মানুষ খাদ্য সংরক্ষনের জন্যে খাদ্যকে শুকিয়ে পানিমুক্ত করে নিতো কারন পানি থাকলে তা সহজেই বিভিন্ন ব্যাকটেরিয়া দ্বারা পচে নষ্ট হয়ে যেতো। শুটকি মাছ তেমনি একটি প্রাচীন পদ্ধতির ফলে তৈরি হয়ে আসছে। তাজা মাছের শরীর থেকে বিভিন্ন অংশ ফেলে দিয়ে বাকি অংশকে খোলা বাতাশযুক্ত ও টাটকা রোদে ভালোভাবে শুকিয়ে পানিমুক্ত করা হয়। এতে করে আর ক্ষতিকর অনুজীব থাকে না। মাছ সংরক্ষনের এই পদ্ধতি সহজ ও তুলনামূলক কম ব্যয়বহুল। শুটকি মাছের আয়ুষ্কাল কয়েকবছর পর্যন্ত হতে পারে।
বাংলাদেশ শুটকি উপাদনে বিশ্বে অন্যতম একটি দেশ। ২০০৬-১২ অর্থ বছরগুলোতে বাংলাদেশ প্রতিবছর প্রায় ২০০কোটি টাকা মূল্যের শুটকি বিদেশে রপ্তানি করেছে। বাংলাদেশ মধ্যপ্রাচ্য, হংকং, শ্রীলংকা, পাকিস্তান, আমেরিকা,ব্রিটেনে শুটকি রপ্তানি করে।
বাজারে অনেক ধরনের শুটকি মাছ পাওয়া যায় তার মধ্যে এখানে আমি কয়েকটি উল্লেখ করলাম। লইট্টার শুটকি, ট্যাংরার শুটকি,চিংড়ির শুটকি,ছুরি শুটকি, নোনা ইলিশের শুটকি,
ফাইস্যা মাছের শুটকি এছাড়াও আরো অনেক ধরনের শুটকি পাওয়া যায়। এবার চলুন আমরা শুটকি মাছের উপকারিতা সম্পর্কে সংক্ষেপে জেনে নিই।
হরমোনাল ব্যালেন্স রক্ষায়ঃ আমরা জানি যে হরমোন আমাদের শরীরের অত্যন্ত গুরুত্বপূর্ণ উপাদান। কারো মন ভালো থাকা কিংবা খারাপ থাকাও হরমোন নিয়ন্ত্রণ করে।
শরীরের ভারসাম্য রক্ষায় হরমোন অন্যতম ভূমিকা রাখে। থাইরয়েড হরমোন নিয়ন্ত্রিত মাত্রায় না থাকলে আমাদের হাইপ[র থাইরয়েড বা হাইপো থাইওরয়েড হয় যা বিভিন্ন জটিল রোগ সৃষ্টি করে। আবার, প্রজনন হরমোন যেমন, টেস্টোস্টেরন, ইস্ট্রোজেন, প্রজেস্টেরন এসব হরমোন ইমব্যালেন্স হলে নারীরা সন্তান জন্মদানে অক্ষম হয়ে পড়ে । পুরুষরাও হারায় যৌন ক্ষমতা। শুটকি মাছ এসব হরমোনগুলোকে ব্যালেন্স রাখতে সহায়তা করে।
দেহের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা বাড়ায়ঃ বর্তমানে আমাদের দৈনন্দিন যান্ত্রিক জীবন ও ভেজাল খাবারের কারনে আমাদের শরীর অনেকটা রোগ প্রতিরোধ শূন্য হয়ে পড়েছে। ফলে এখন আমরা অল্পতেই নানান ধরনের রোগে আক্রান্ত হয়ে যাচ্ছি। এবারের করোনায় দেখা গেছে যারা মোটামুটি ফিজিক্যালি পরিশ্রম করে ও ফিটনেস ভালো তাদের করোনাজনিত জটিলতা, মৃত্যুহার কম অপরদিকে যারা শারীরিক পরিশ্রম করেন না শরীর রুগ্ন তাদের সারভাইভ করা খুব কঠিন হয়ে পড়েছে। শুটকির উচ্চ মাত্রার প্রোটিন শরীরের রোগ প্রতিরোধ ক্ষমতা স্ট্রং করে তোলে । ফলে দেখা যায়, যারা নিয়মিত শুটকি খায় তাদের সর্দি, কাশি, ঠান্ডা জ্বর, নিওমোনিয়া কম হয়। একটা বিষয় খেয়াল করলে দেখা যায়, আমরা সাধারন কোনো মানুষ বেশিক্ষন পানিতে থাকলে এমনকি একটু বৃষ্টিতে ভিজলেও জ্বর ঠান্ডা লেগে যায় অথচ জেলেরা দীর্ঘক্ষন পানিতে কাজ করলেও তাদের এসব সমস্যা খুব একটা দেখা যায় কারন তারা মাছ ও মাছের শুটকি বেশি খায়।
কোলেস্টেরল এর সমস্যায়ঃ বয়স একটু বাড়লেই এখন আমাদের দেশে মানুষের হার্টের
সমস্যা দেখা দেয়। খারাপ কোলস্টেরল জমে হার্টে ব্লক হয় । অনেকেই নিয়মিত কোলস্টেরল কমানোর ঔষধ খান। ওমেগা-৩ এর ক্যাপ্সুল পাওয়া যায় এখন বাজারে যারা নিয়মিত খান তারা ভালো করেই জানেন । শুটকি মাছে ওমেগা-৩ থাকে যা রক্তের হাই ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন(এইচডিএল) বৃদ্ধি করে এবং লো ডেনসিটি লিপোপ্রোটিন(এলডিএল) কমায়।
কর্মদক্ষতা বৃদ্ধিতেঃ যারা নিয়মিত শারীরিক পরিশ্রম করেন তারা শুটকি মাছ খেতে পারেন। তাতে শরীরের ক্যালরির চাহিদা পূর্ন হবে ও শরীর কর্মক্ষম থাকবে।
রক্তস্বল্পতায়ঃ যারা রক্তস্বল্পতায় ভুগছেন তারা নিয়মিত শুটকি মাছ খেতে পারেন। আপনারা জানেন শরীরে আয়রন, জিংক, ফলিক এসিড এসবের অভাব থাকলে শরীরে রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। আর রক্তস্বল্পতা দেকাহ দিলে শরীর অল্পতেই ক্লান্ত হয়ে যায়, বুক ধড়ফড় করে কাজ কর্মে মন বসে না । শুটকি মাছে প্রচুর আয়রন সোডিয়াম এসব থাকে যা শরীরে রক্তের পরিমান বাড়ায় এবং এনিমিয়া দূর করে।
গর্ভবতি মায়েদের জন্যেঃ গর্ভবতী মায়েদের শরীরে অনেক সময় রক্তস্বল্পতা দেখা দেয়। এ সময় প্রচুর আয়রনের প্রয়োজন হয় ডাক্তারগন নানা ধরনের আয়রনের ট্যাবলেট দিয়ে থাকেন। শুটকি মাছও হতে পারে এই ট্যাবলেট এর বিকল্প।
এসব ছাড়াও শুটকি মাছ প্রচুর পুষ্টি উপাদানে পরিপূর্ণ। প্রোটিন, ফসফরাস, পটাশিয়াম, সেলেনিয়াম, নায়াসিন, ভিটামিন-বি-১২ ইত্যাদি । উপাদানগুলোর মধ্যে ৮০-৮৫ শতাংশ প্রোটিন বা আমিষ যা দেহের জন্যে খুবই প্রয়োজনীয় । অনেকের মস্তিষ্কে রক্ত সঞ্চালন কম হয় তারা বিভিন্ন ঔষধ খাচ্ছেন এ সমস্যায় শুটকিতে থাকা ভিটামিন-বি-১২ এ সমস্যায় খুব ভালো কাজ করে। শুটকি মাছে থাকা পটাশিয়াম শরীরে পানির ভারসাম্য রক্ষা করে এবং রক্তচাপ নিয়ন্ত্রন করে, হৃতপিন্ডের কাজে সহায়তা করে। ফসফরাস হাড়ের গঠন, দাতের গঠন শক্ত ও মজবুত করে। নায়াসিন স্নায়ুতন্ত্র, পরিপাকতন্ত্র ও ত্বক সুস্থ রাখে।
শুটকি মাছ যেভাবে খাওয়া হয়ঃ শুটকি মাছ অনেকভাবেই খাওয়া যায়। রান্না করে, ভর্তা করে, বিভিন্ন তরকারীর সাথে শুটকি মাছ খাওয়া যায়। তবে গ্রামে শুটকি মাছের ভর্তা করে
খাওয়াই সবচেয়ে বেশি প্রচলিত। শহরে অনেকেই শুটকি মাছ দিয়ে বিভিন্ন ধরনের রেসিপি তৈরি করেন যেগুলো অনেক সুস্বাদু যেমনঃ মসুরের ডালের সাথে কাচকি শুটকির চচ্চড়ি, চ্যাপা শুটকির বাগার ভর্তা, নুনাঝুরি,লইট্টা শুটকি ভুনা ইত্যাদি।
একেক মাছের শুটকির দাম এক এক রকম। লইট্টা শুটকি কেজি প্রায় ৭০০টাকা, সরপুটি শুটকি কেজি ৫০০-৬০০টাকা, ভালো ছুরি শুটকি কেজি প্রায় ১২০০-১৫০০টাকা, কাচকি,চ্যালা,মলা,ভর্তা চিংড়ী এগুলো কেজি কমবেশি ৫০০টাকার মতো, নুনা ইলিশ ছোট বড় সাইজের ৫০০-১০০০টাকা।
যারা বানিজ্যিকভাবে শুটকি উৎপাদন করেন না তারা চাইলে বাড়িতেও শুটকি মাছ তৈরি করে সংরক্ষন করতে পারেন। এজন্যে যা করবেন তা হলোঃ প্রথমে মাছের আইশ ও ভিতরের পচনশীল অংশ কেটে ফেলে দিতে হবে। তারপর ভালোভাবে ধুয়ে কিছু সময় (১০-১২ ঘন্টা) লবন পানিতে চুবিয়ে রাখা ভালো তাতে এটি জীবানুমুক্ত হবে। লবনপানি থেকে উঠিয়ে পুনরায় মাছকে পানিয়ে ধুয়ে কিছুক্ষন স্বাভাবিক পানিতে চুবিয়ে রাখবেন। এরপর ৩-৫দিন কড়া রৌদে শুকাতে হবে, শুকানোর সময় খেয়াল রাখতে হবে যাতে এতে কোনো কীট পতঙ্গ না ধরে । এভাবেই ৩-৫দিন শুকালেই শুটকি সংরক্ষনের উপযোগী হয়ে যাবে।
সতর্কতাঃ বানিজ্যিকভাবে শুটকি উৎপাদনের সময় এতে প্রচুর লবন ব্যবহার করা হয় তাই যাদের উচ্চ রক্তচাপ ও হৃদরোগ আছে তারা চিকিৎসকের পরামর্শ নিয়ে এটি সেবন করবেন।
কিডনি ও লিভার রোগে আক্রান্তদের শুটকি সেবন উচিৎ নয় কারন এর মধ্যে থাকা উচ্চ মাত্রার প্রোটিন এসব রুগীরা হজম করতে পারবেনা।
প্রক্রিয়াজাত করার সময় এর মধ্যে বিভিন্ন রাসায়নিক দ্রব্যাদি ব্যবহার করা হয় যেগুলো শরীরের জন্যে ক্ষতিকর । তাই শুটকি রান্না করার আগে কিছুক্ষন গরম পানিতে চুবিয়ে রাখুন।
কিডনিতে পাথর রয়েছে এমন রুগী শুটকি গ্রহন থেকে বিরত থাকা উচিৎ।
বাড়িতে বেশিদিন শুটকি রাখতে হলে মাঝে মাঝে কড়া রোদে শুকাতে দিতে হবে।